১।নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয় - নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয় হলো নদী-খাল, বিল-ঝিল, হাওড়-বাঁওর ইত্যাদি।এসব জলাশয়ে পাওয়া যায় মিঠা পানির মাছ।যেমন-রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস, কালি বাউস, আইড়, বোয়াল, চিতল, বাটা, চিংড়ি ইত্যাদি।
হালদানদীরনামকরণঃ
কথিত আছে যে, খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকে অর্থাৎ বাংলার স্বাধীন সুলতানী শাসনের শুরুর দিকে, হযরত সৈয়দ বখতিয়ার মাহি সওয়ার (রহঃ) নামে একজন অলী আল্লাহ , পূর্ববঙ্গে ইসলাম প্রচারের উদ্দ্যেশে সুদুর ইরাকের সেই ঐতিহাসিক কারবালার নিকটবর্তী ফোরাত নদী থেকে এক বৃহদাকৃ্তির মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে পারস্য উপসাগর পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছান।সাগরের মোহনা বরাবর আরো সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি যখন চট্টগ্রামের কর্ণফূলী নদীতে প্রবেশ করেন তখন এ মর্মে গায়েবী নির্দেশ প্রাপ্ত হন,“উনযুর হা উলায়ি এয়া বখতিয়ার”, অর্থাৎ - ‘তোমার সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত কর, হে বখতিয়ার, এটাই তোমার গন্তব্য!’ কর্ণফূলী নদীর যে অংশে এসে তিনি অবতরণ করেছিলেন সে অংশের নামকরণ করা হয় হালদা নদী। কথিত আছে যে, এদেশে আগমণের পর তিনি বর্তমান চট্টগ্রাম শহর থেকে ৫/৭ মাইল দুরবর্তী কালুরঘাট সেতুর নিকট নিকটস্থ তৎকালীন হালদা নদীর তীরে অবতরণ করেন।মতান্তরে তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন নদীর তীরে অবতরণ করেছিলেন ।এই ‘হাউলায়ি’ শব্দের অপভ্রংশ থেকে হালদা নামটি উৎপন্ন হয়েছে বলে কিংবদন্তী রয়েছে।যদিও কিংবদন্তী ইতিহাসের অংশ নয়, তবুও সাধারণ মানুষজন এসবে বিশ্বাস করে।
মাছের পিঠে আরোহণ করে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন বিধায় তাঁকে ‘মাহি সওয়ার’ আখ্যায় আভিহিত করা হয়।তাঁর কয়েকপুরুষ পরবর্তী বংশধর হলেন ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরীফের প্রতিষ্টাতা হযরত শাহ্ সূফী দায়েম(রহঃ) এবং চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের আধার মাানিক গ্রামের সৈয়দ আউলিয়া (রহ:) ও সৈয়দ জমির উদ্দিন (রহ:)।
উৎসওগতিপথঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বনোতলী পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে হালদা নদী ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে।এরপর এটি আরো দক্ষিন পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে বিবিরহাট, নাজিরহাট, হাটহাজারী হয়ে সর্তার ঘাট দিয়ে প্রবেশ করেছে রাউজান উপজেলায়।রাউজানে এসে এটি আরো দক্ষিন দিকে গিয়ে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা গ্রাম অতিক্রম করেছে। এরপর হালদা নদী মোবারক খান খীল গ্রামের পাশ দিয়ে সোনাই মূখ ও বিনাজুরী হয়ে কাগতিয়া অতিক্রম গিয়ে পৌঁছেছে।এরপর এটি পশ্চিম গুজরা, কেরানীহাট, উরকির চর, লাম্বুর হাট, কচুখাইন পার হয়ে কালুর ঘাট দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে।এভাবে হালদা নদীর মোট দৈর্ঘ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ মাইল যা প্রায় ৮১ কিলোমিটারের সমান।
হালদানদীর মৎস্যক্ষেত্র–
‘হালদা নদী’তে রয়েছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র।এছাড়া হালদা নদী হলো সারা বিশ্বে স্বাদু পানির মাছের জন্যও একমাত্র স্বাভাবিক তথা প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র।হালদা নদীতে অবস্থিত প্রাকৃতিকভাবে মাছের ডিম প্রজননের এ ক্ষেত্রটি পূর্ব বঙ্গের মৎস্য চাষ এবং আহরণের জন্য অতি প্রাচীনকাল থেকেই খ্যাতি ও গুরুত্ব অর্জন করেছিল।এখান থেকেই এককালে সারা পূর্ব বঙ্গে ইন্ডিয়ান কার্পস এর পোনা চালান যেতো।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী দেখা যায় যে, “মা মাছেরা নদীতে ডিম ছাড়ার পর প্রায় দুই হাজার নৌকা নিয়ে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা নদী থেকে এসব নিষিক্ত ডিম আহরণ করেন।গড়দুয়ারা স্লুইচ গেট, কান্তর আলী হাট, চৌধুরী হাট, নয়া হাট, সিপাহীর ঘাট, বংশাল ঘাট, পোড়ালীয়া ঘাট, রামদাশ হাট, ও মদুনা ঘাট থেকে মা মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়”।তখন হাজার হাজার মানুষ নৌকা নিয়ে সোৎসাহে বেড়িয়ে পড়ে।আর দিন-রাত কাটিয়ে দেয় মাছ ধরার নৌকায়।হালদা নদীর দু’ তীরের গ্রামগুলো জুড়ে গড়ে উঠেছে স্থানীয় প্রযুক্তিতে মা মাছের ডিম থেকে পোনা ফোটানোর প্রক্রিয়া।যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে এখানে চলে আসছে এ ব্যবসা।
কার্প(রুই,কাতলা,মৃগেল,বাউস)জাতীয় মাছের জন্য ‘বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃ্তিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র’ হালদা নদীর দু’পাশে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা শত শত রেনু পোনা চাষের খামারে খনন করা হয়েছে বহু সংখ্যক কুয়া।বর্ষার প্রথম বর্ষণের পর মা মাছেরা হালদা নদীতে এসে ডিম পাড়ে।সে ডিম আহরণ করে কুয়ায় সংরক্ষণ করা হয়।তারপর কুয়ার পানিতে নিয়মিত জোয়ার-ভাটার পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রেনু পোনা উৎপাদন করা হয়।মওশুম আরম্ভ হলে হালদা নদীর দুই তীরে শুরু হয় রেণু পোনা আহরণের মহোৎসব। সারা দেশ থেকে পাইকার, ব্যবসায়ী ও মাছ চাষীরা এসে কিনে নিয়ে যায় এখানকার রেণূ পোনা।তাঁদের ব্যবসার পরিমানও কম নয়, প্রতি মওসুমে প্রায় শত কোটি টাকা।এতে কয়েক হাযার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।ফলে সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের মুখ দেখছে এলাকার কর্মজীবী পরিবারের মানুষজন।
তবে দূ্ঃখের বিষয় যে, বর্তমানে মা মাছের নিষিক্ত ডিমের পরিমান আশংকাজনকভাবে কমে গেছে।তাছাড়া ডিম সংগ্রহকারীদের মতে আজকাল সময়মতো মা মাছেরা নদীতে ডিম ছাড়ছেনা।বিশেষজ্ঞগণের মতে এর কারণ হলো, গড়দুয়ারা এলাকায় বাঁক কেটে নদীর পথ পরিবর্তন, আবহাওয়ার পরিবর্তন, অপরিকল্পিতভাবে সংযোগ খালগুলোর স্লুইচ গেট নির্মাণ, নদী দূষণ ইত্যাদি।
এছাড়াও সর্তা, মুকদারা, কাগতিয়া প্রভৃতি নদী আর ডোমখালী, ডাবুয়া প্রভৃতি খালগুলোতেও বিভিন্ন জাত ও স্বাদের প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়।যা টিকিয়ে রেখেছে এতদাঞ্চলের শ্রমজীবী জেলে পরিবারগুলোকে।তাঁদের আহরিত মাছ এলাকার মানুষের আমিষের চাহিদা মিটাচ্ছে।
আবার হ্যাচারী স্থাপন করেও কৃ্ত্রিমভাবে মাছের পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে।যদিও অনেকক্ষেত্রে এগুলোর গুনগত মান আসল রেনু পোনার সমকক্ষ হয় না।আগেই বলেছি সেই বৃটিশ যুগেও এখানকার রেণু পোণা সারা বাংলায় রপ্তানী হতো ‘ইষ্টার্ন কার্পস’ নামে।তাই কাব্য করে বলতে ইচ্ছে হয় ‘হালদার পোণা, বাংলার সোনা’ ‘হালদার মৎস্য, বাংলার গর্ব’।
সুখের কথা, বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের অদুরবর্তী হালদা নদীর উৎস মুখ থেকে মদুনা ঘাট পর্যন্ত মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে সরকারীভাবে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে।স্বাদু অর্থাৎ মিঠা পানির মাছের জন্য বিশ্বের একমাত্র এ প্রাকৃ্তিক প্রজনন ক্ষেত্রটির উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করার জন্য গৃহীত হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকার বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, একেকটি মা মাছ সারা জীবনে প্রায় ৪/৫ কোটি টাকা মুল্যের ডিম ছাড়ে।কিন্তু অতি দূঃখের বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, কিছু সংখ্যক অতি লোভী, অবিবেচক ও সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী ব্যক্তি হালদা নদীতে আসা এসব ডিমওয়ালা মা মাছগুলো কে নির্বিচারে শিকার করে বাজারে বিক্রি করছে। এ ব্যপারে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন।সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগগুলোর এ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে তৎপর হওয়া আবশ্যক।আইন অমান্যকারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।তবেই বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।এছাড়া হাটহাজারী এলাকায় স্থাপিত বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জে প্রতিনিয়ত দূষিত হয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় হালদা নদীর মহামূল্যবান প্রাকৃ্তিক মৎস্য ভান্ডার।ফলে নষ্ট হচ্ছে এখানকার জীব বৈচিত্র, প্রাকৃ্তিক ভারসাম্য এবং হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির শত রকম মাছ।যথাশিঘ্র এ নদী দূষন বন্ধের বিরুদ্ধে যথাবিহিত ব্যবস্থা না নিলে আচিরেই ধংশ হয়ে যাবার সমূহ আশংকা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের এ অমূল্য আধার হালদা নদী।
হালদা নদীকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ’(WorldHeritage) হিসেবে ঘোষনা করা আজ সময়ের দাবী।সকল রাউজানবাসী জনগণকে তাই আজ একযোগে বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারী ফোরামে তাঁদের মহামুল্যবান এ প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার ও প্রজনন ক্ষেত্রটিকে রক্ষার দাবী জোর গলায় উত্থাপন করতে হবে।
২।কৃত্রিমজলাশয়েরমাছ-
এসব জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, দীঘি ইত্যাদি। এগুলোতে পাওয়া যায় রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস, কালি বাউস, শোল, গজার প্রভৃতি।
এতদাঞ্চলের পুকুর ও জলাশয়গুলোতে আজকাল কৃ্ত্রিম উপায়ে বিভিন্ন প্রকার কার্প এবং নাইলোটিকা জাতীয় মাছের চাষ করা হচ্ছে।যা এ এলাকার বিপুল সংখ্যক জন গোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মিটাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি মৎস্য চাষ সমাজে একটা একটা সম্মানজনক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
২।কৃত্রিমজলাশয়েরমাছ-
এসব জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, দীঘি ইত্যাদি।এগুলোতে পাওয়া যায় রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস, কালিবাউস, শোল, গজারপ্রভৃতি।এতদাঞ্চলে রপুকুরওজলাশয় গুলোতে আজকাল কৃ্ত্রিম উপায়ে বিভিন্ন প্রকার কার্প এবং নাইলোটিকা জাতীয় মাছে চাষকরা হচ্ছে।যা এ এলাকার বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর আমিষে রচাহিদা মিটাচ্ছে এবং এরপাশাপাশি মৎস্য চাষ সমাজে একটা একটা সম্মানজনক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
কর্ণফুলী নদী
রাউজানউপজেলার ঠিক মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলি নদী । কর্ণফুলী নদীবাংলাদেশেরদক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রধান নদী। এটি ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়েশুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েপ্রবাহিত হয়েচট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীরমোহনাতেবাংলাদেশের প্রধান সমূদ্র বন্দরচট্টগ্রাম বন্দরঅবস্থিত। এই নদীরদৈর্ঘ্য ৩২০কিলোমিটার। রাউজান উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এনদী যারাউজান উপজেলাকে করেছে সমৃদ্ধ । প্রায় ১১০০ জেলের জীবন ও জীবিকা এইনদীর উপর নির্ভরশীল । এ নদীটি হালদা নদীর সাথে রাউজান উপজেলার মদুনাঘাটএলাকাতে যুক্ত হয়েছে । হালদা নদী রুইজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রহিসবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কর্ণফুলী নদী হালদার সাথে যুক্ত থাকায় বছরেরএকটি বিশেষ সময় মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকে যা আমাদের মৎস সম্পদকে আরওবেশী সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস